আল্লাহপাকের উপর সবসময় নির্ভর করা মু'মিনের দায়িত্ব
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৩ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:০৫:২২ রাত
আসরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করে নিজের তহবিলে এসে বসলেন।
মেঘনার পাড়ে তহবিল। এখন মওসুম। নদীতে এবং সাগরেও ‘গোন’ চলছে। প্রচুর ইলিশের ছড়াছড়ি।
আলহামদুলিল্লাহ! সবই আল্লাহর ইচ্ছা। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলেন রেজাউল সাহেব।
একজন অবসরপ্রাপ্ত শুল্ক কর্মকর্তা। বছর চারেক হল অবসরে গেছেন। এখন নিজের মাছের ব্যবসা দেখাশুনা করেন। কয়েকটি ট্রলার আছে। সেগুলো সাগরে মাছ ধরতে যায়। এ ছাড়া তহবিল রয়েছে। তবে মাঝিদের ‘দাদন’ দেন না। এটা সরাসরি হারাম। তাই নিজের পুঁজি খাঁটিয়ে সৎ ভাবে ব্যবসা করছেন। আর আল্লাহপাকের রহমতে বেশ ভালই আছেন।
অবশ্য আল্লাহপাক ভালো-খারাপ যে অবস্থায়ই রাখুন না কেন, একজন মুসলমান হিসাবে উভয় অবস্থায়ই দিলের হালত একই রকম অর্থাৎ পজিটিভই রাখা ঈমানী কর্তব্য। জানালা দিয়ে অদূরে ঘাটের মাঝিদের কর্মব্যস্ততা দেখতে দেখতে নিজের শুভ্র দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবনার জগতে চলে যান রেজাউল করিম... ...
তখন চাকুরির সুবর্ণ সময়। একজন শুল্ক এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত রয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে। বৈধ আয়ের থেকে অবৈধ আয়ই বেশী। লাক্সারিয়াস জীবন যাপন করছেন চট্টগ্রামের একটি আবাসিক এলাকায়। এক ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে জীবনের চাওয়া-পাওয়ারও অতিরিক্ত ইচ্ছেঘুড়িগুলোকে বাস্তবের নীলাকাশে উড়াতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। নিজে নামাজ পড়তেন না। ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী ও তার পদাংক অনুসরণ করে চলেছেন। গান-বাজনা এবং রঙ ঢঙ্গে কেটে যাচ্ছিল মহামূল্যবান সময়। এই চাকুরি করা অবস্থায়ই ট্রলার কিনে লোক দিয়ে মাছের ব্যবসা শুরু করলেন। ৪০ লক্ষ টাকা দিয়ে একটি ৭৮ অশ্ব শক্তির সৌখিন ট্রলার তৈরী করলেন। ভালোই চলছিল সব কিছু।
একদিন অফিস থেকে বের হয়ে অফিসের গাড়িতে বাসায় ফিরছিলেন। ড্রাইভার বেশ পুরনো-বয়ষ্ক লোক। ইসলামী অনুশাসন মেনে চলে। কার সেটে সূরা আর-রাহমান অনুবাদসহ তেলাওয়াত হচ্ছিল। আয়াতগুলোর অর্থ এবং তিলাওয়াত রেজাউল করিম সাহেব গভীর মনোযোগে শুনতে থাকেন। মুহুর্তগুলো কেমন এক ঘোরের ভিতর কেটে যায়। আল্লাহপাকের উদাত্ত জিজ্ঞাসা, ‘ সুতরাং তোমরা রবের কোন কোন দানকে অস্বীকার করবে?’ – তার মনের গভীরে ব্যকুলতার সৃষ্টি করে। হৃদয় আন্দোলিত হয়... কেমন বিচলিত বোধ করেন। এরপর বাসায় ফিরে একা একা দীর্ঘক্ষণ ভাবেন। নিজের ভিতর থেকে কে যেন বলে, ‘ এখনো কি তোমার ফিরে আসার সময় হয় নি?’
সেদিন থেকেই নামাজ পড়া শুরু করলেন। কোরআন অর্থসহ তিলাওয়াত শুনতে থাকেন। এরপর স্টাডি করা শুরু করেন। ইবনে কাছির, ইবনে জরীর, ইমাম গাজ্জালী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর লিখা পড়া শুরু করেন। মোটকথা ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তবে এর জন্য তার আশেপাশের মানুষেরা তার থেকে ক্রমশঃ দূরে সরে যেতে থাকেন। নিজের স্ত্রী, সন্তান এবং অফিসের কলিগেরাও আলগা থাকা শুরু করে। তবে নিজের নতুন গড়ে উঠা এই আনন্দময় ভূবনটিতে একেলা থেকেও রেজাউল করিম সাহেব হতদ্যম হয়ে পড়েন না। কারন তার সাথে যে সেই মহামহিম আল্লাহপাক ছিলেন!! যিনি তাঁর বান্দাদের সাথে সবসময়েই থাকেন। কিন্তু আফসোস, বান্দারা সেটি বুঝে না।
ধীরে ধীরে রেজাউল করিম সাহেব ইসলামের সুশীতল ছায়ায় পথ চলতে থাকেন। কিন্তু আল্লাহপাকের ইচ্ছেটা একটু অন্যরকম ছিল। অফিসে যে কোন একটা বড় ধরণের গোলমালে ৩০ জন কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়। রেজায়ল করিম সাহেবও এদের ভিতরে পরে যান। তবে ওনারা হাইকোর্টে আপীল করেন। মামলা চলতে থাকে। জীবনও নিজের গতিতে চলতে থাকে। আগের সেই লাক্সারিয়াস জীবনে ভাটা পরে যায়। মোটামুটি মানের একটি দুই রুমের ভাড়া বাসায় পরিবার সহ শিফট হয়ে যান। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করেই গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেলেন না। জমানো টাকা খরচ হতে থাকে। হঠাৎ করে এই অবস্থার পরিবর্তনে রেজাউল করিম সাহেবের সামাজিক মর্যাদারও অধঃপতন হতে থাকে। পরিচিত জনেরা দূরে দূরে থাকা শুরু করে। তবে আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি অটল থাকেন।
এই অবস্থার ভিতরে তার উপর আরো একটি বিপদ নেমে আসে। তার ৭৮ ইঞ্জিনের ট্রলারটি সুন্দরবন এলাকায় সৃষ্ট সুনামির কবলে পড়ে সমুদ্রে ডুবে যায়। এরকম ক্রিটিক্যাল অবস্থায় ৪০ লক্ষাধিক টাকার সমমূল্যের সম্পদটি মুহুর্তে পানির অতলে নিমজ্জিত হয়ে যায়। তবুও আল্লাহর উপর থেকে রেজাউল করিম সাহেবের আস্থা একচুলও কমে না। তিনি বুঝতে পারেন, এগুলো আল্লাহপাকের তরফ থেকে তার উপরে পরীক্ষা। তিনিও ঈমানের দৃঢ়তায় সেই পরীক্ষা পাসের জন্য নির্ভার থাকেন।
এভাবে চাকরিহীন তিনটি বছর কেটে যায়। কত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন তা লিখে লিখার কলেবর বৃদ্ধি করার প্রয়োজন নেই। তবে আল্লাহপাকের ইচ্ছেতে এই পরিবারের বাকি তিনজন সদস্যও ইসলামের সুশীতল ছায়ায় চলে আসে। এদের ভিতরে এক আমূল পরিবর্তন চলে আসে। ইসলামী ভাবধারায় নিজেদেরকে মানিয়ে নেয় তারা। আর তখনই আসে আল্লাহপাকের সাহায্য। হাইকোর্ট রেজাউল করিমদের উপর অন্যায় করা হয়েছে এ মর্মে তাদেরকে পুনরায় চাকুরিতে বহাল করার আদেশ প্রদান করেন।
এরপরের ঘটনা কেবলই সামনে এগিয়ে যাবার। সৎ ভাবে চাকুরির বাকি সময়টা কাটান। অবসের যান। তবে অবসরে যাবার সময় যে টাকা পান, সেগুলো মাছের ব্যবসায় খাঁটিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছে যান। একজন সফল ব্যবসায়ী... একজন সৎ ব্যবসায়ী... ...
ভাবনার জগৎ থেকে একজন রেজাউল করিম সাহেব ফিরে আসেন। ভাবালুলতায় একটু প্রগলভ হয়ে পড়েন। আল্লাহপাকের রহমত এবং দয়ার কথা মনে করে চোখের দু’পাশ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গাল এবং শুভ্র শুশ্রুমন্ডলকেও ভিজিয়ে দেয়। গরম সেই ‘প্রেমজল’ দোজখের আগুনকে নিভিয়ে দেবার জন্যও যথেষ্ট।।
উপরের ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম, একজন ধর্মহীন মানুষ যখনই ধর্মের পথে ফিরে এলো, তার উপর একের পর এক বিপদ নেমে আসতে থাকলো। তবে এগুলোকে তিনি কাটিয়ে উঠেছেন আল্লাহর উপর পরম নির্ভরতাকে সাথী করে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন এরকম পরীক্ষা নেমে এলো তার উপর। তিনি তো সঠিক পথেই চলা শুরু করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে এই বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে জানিয়েছেন। সূরা বাকারার ১৫৫ নং আয়াতে আল্লাহপাক এরশাদ করেন,
“ আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব, কিছুটা ভয়, ক্ষুধা এবং ধন, প্রাণ এবং ফল-ফলাদির ক্ষতি দিয়ে, আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদেরকে।“
সূরা আলে-ইমরানের ১৭৯ নং আয়াতে আল্লাহপাক এরশাদ করেন,
“ যে অবস্থায় তোমরা আছ সে অবস্থায় আল্লাহ মু’মিনদেরকে ছাড়তে পারেন না; যতক্ষণ না পবিত্র হতে অপবিত্রকে পৃথক করতে পারেন; আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদেরকে খবর দেবেন অদৃশ্যের; তবে আল্লাহ রাসূলদের মধ্য হতে ইচ্ছামত বেছে নেন, অতএব আল্লাহ ও রাসূলদের বিশ্বাস কর; যদি তোমরা ঈমান আন আর ভয় কর, তবে তোমাদের জন্য রয়েছে বড় প্রতিদান। “
এভাবে আল্লাহপাক নিম্নোক্ত সূরাসমুহের নিম্নোক্ত আয়াতসমুহে এই পরীক্ষা নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন-
সূরা আলে-ইমরানঃ ১৮৬ নং আয়াত
সূরা আন‘আমঃ ১৬৫ নং আয়াত
সূরা আরাফঃ ৯৪, ৯৫, ১৬৩ নং আয়াত
সূরা তাওবাহঃ ১৬ নং আয়াত
সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৬০ নং আয়াত
সূরা ত্বহাঃ ১৩১ নং আয়াত
সূরা আম্বিয়াঃ ৩৫ নং আয়াত
সূরা মু’মিনুনঃ ৫৪-৫৬ নং আয়াত
সূরা ফুরকানঃ ২০ নং আয়াত
সূরা ‘আনকাবুতঃ ২-৩ নং আয়াত
সূরা রুমঃ ৪১ নং আয়াত
সূরা সাজদাহঃ ২১ নং আয়াত
সূরা ছফফাতঃ ১০২-১০৫ নং আয়াত।
এভাবে আল্লাহপাক আমাদের বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করবেন। তবে আল্লাহপাক কোনো বান্দার সাধ্যাতীত কোনো দুঃখ-কষ্টই তার উপর চাপিয়ে দেন না। তাই যতই আমাদের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেয়া হোক না কেন, তাতে ভেঙ্গে পরা যাবে না। কারণ আল্লাহপাক নিজেই অন্যত্র আমাদেরকে বলে দিচ্ছেন-
"অনন্তর নিশ্চয়ই দুঃখের সাথে রয়েছে স্বস্তি" [সূরা আলাম নাশরাহ, আয়াত নং ৫]"
এর পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহপাক বলছেন-
" অবশ্যই দুঃখের সাথে রয়েছে স্বস্তি" [সূরা আলাম নাশান করুণরাহ, আয়াত নং ৬]
যেখানে আমার সৃষ্টিকর্তাই আমাকে ওভারশিওর করছেন যে, দুঃখকষ্ট যা-ই এই চোখে দেখছি, এরপরেই এক অনাবিল সুখের অনুভূতি আসছে। তাই হতাশ হওয়া যাবে না। আর মু'মিনদেরকে একমাত্র আল্লাহপাকের উপরেই সর্বহালতে নির্ভর করা উচিত।
আল্লাহপাক আমাদের সকলকে সর্বধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষাতে অটল থেকে মৃত্যুবরণ করার তৌফিক দান করুন-আমীন।
বিষয়: বিবিধ
৯৫৬ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার মন্তব্যটুকু উপভোগ করলাম, এই অনুপ্রেরণা আমাকে সামনের লিখাগুলোতে এগিয়ে যেতে গতি জোগাবে।
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, সেজন্য অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আল্লাহ্ আপনাকে, আমাকে, সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন, বুঝার তৌফিক দান করুন।
সহমত আপনার সাথে।
আপনার দোয়ায় আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অসাধারণ প্রেরণা মূলক লেখা। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
অনুভূতি এবং প্রেরনা রেখে যাবার জন্য অনেক সাধুবাদ রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ইতিবাচক এ লেখাটির জন্য আপনাকে বিশেষভাবে মোবারকবাদ-
আপনি কথা রেখে চলেছেন দেখে আমার খুব ভালো লাগছে
নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালাও উত্তম জাযআ দেবেন ইনশাআল্লাহ
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। এই পথে আমাকে চলার অনুপ্রেরনা এই ব্লগে আপনার মত গুটিকয়েক সিনিয়র ব্লগার ভাইয়ারা দিয়েছেন। তাই শুরুটা করলাম। দোয়ার প্রত্যাশা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ঈদের শুভেচ্ছা রইল আপনাদের সকলের জন্য
আপনার দোয়ায় আমীন।
আপনার এবং আমাদের টুডে ব্লগের সকলের মঙ্গল কামনা করছি। আল্লাহপাক কবুল করুন-আমীন।
আপনার ও আপনার পরিবারের সকলের জন্যও রইলো ঈদের শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
"তোমাদের মধ্যকার ভালো-সৎ কর্মশীলদের কে বিপদাপদে-মুসিবতে ফেলে আমি যাচাই করি প্রকৃত ই তোমরা তা কি-না।"
উপলব্ধিঘেষা অসাধারণ লিখনীর জন্যে শুভেচ্ছা ও জাযাকাল্লাহু খাইরান আপনাকে.....।
ধন্যবাদ আপনার সুন্দর অনুভূতিটুকুর নির্যাস ছেড়ে যাবার জন্য। আপনার দোয়ায় আমীন।
আপনাদের জন্যও রইলো ঈদের শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ঈদ মোবারক।
আপনার দোয়ায় আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন